সরকারি নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের চারপাশে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে শতাধিক বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই মানহীন। বিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় চাহিদার ন্যূনতমও বিদ্যমান নেই এসব প্রতিষ্ঠানে। শুধু তাই নয়, সরকারি হাসপাতাল থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বেসরকারি চিকিত্সাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের যে নিয়ম রয়েছে, তার কোনো তোয়াক্কা না করে সরকারি রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের সীমানা প্রাচীরসংলগ্ন এলাকা থেকেই গড়ে তোলা হয়েছে এসব বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
অভিযোগ রয়েছে, মূলত রামেক হাসপাতাল থেকে দালালের মাধ্যমে রোগী ভাগিয়ে এনে চিকিত্সার নামে প্রতারণার ব্যবসা করার জন্যই সরকারি হাসপাতালের সন্নিকটে এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে। তার পরও স্বাস্থ্য বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর মদতে অনুমোদন পেয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান। তাদের মদতেই চিকিৎসাসেবার নামে রমরমা প্রতারণা ব্যবসা করছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
খোদ রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ও সিভিল সার্জনের নাকের ডগায় বিধিবহির্ভূত ও মানহীন এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। কিন্তু এগুলোর তদারকি বা মান নিয়ন্ত্রণে নেই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। ফলে চিকিৎসা পাওয়ার বদলে প্রতারিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকারি হাসপাতাল থেকে এক কিলোমিটার বা বিশেষ ক্ষেত্রে আধা কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্থাপনের সুযোগ নেই। কিন্তু সরকারি রামেক হাসপাতাল ও রাজশাহী যক্ষ্মা হাসপাতালের চারপাশে আধা কিলোমিটারের মধ্যেই গড়ে উঠেছে শতাধিক বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
বিশেষ করে রামেক হাসপাতালের পশ্চিম প্রান্তের প্রাচীর ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে ১০টির মতো ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। শুধু তাই নয়, রামেক হাসপাতালের এ প্রান্ত থেকে লক্ষ্মীপুর মোড় হয়ে ঝাউতলা মোড় পর্যন্ত আধা কিলোমিটারের মধ্যেই ছোট-বড় অর্ধশতাধিক বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে।
এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগেরই প্রয়োজনীয় ভৌত (কক্ষ) সুবিধা নেই। নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। নেই ডিউটি ডাক্তার, ডিপ্লোমা নার্স, টেকনিশিয়ান, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ প্রয়োজনীয় জনবল। ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিকের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশও নেই এসব প্রতিষ্ঠানে। বলতে গেলে প্রয়োজনীয় চাহিদার ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান নেই এসব বেসরকারি ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। তার পরও এসব প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য বিভাগের নিবন্ধন পেয়েছে, নবায়নও হচ্ছে। আর এর সুবাদে উন্নত চিকিত্সাসেবার নামে মানুষ ঠকানোর ব্যবসা করছে এসব মানহীন প্রতিষ্ঠান।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি ক্লিনিকের নিবন্ধন পেতে প্রয়োজনীয় ভৌত সুবিধা, সার্বক্ষণিক ডাক্তার, ডিপ্লোমা নার্স, ওয়ার্ডবয়, আয়া, ক্লিনারসহ প্রয়োজনীয় জনবল, যন্ত্রপাতি, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ থাকা আবশ্যক। সূত্রমতে, ১০ বেডের একটি ক্লিনিকের অনুমোদনের ক্ষেত্রে শুধু রোগীর ওয়ার্ডের জন্য প্রতি বেডে ৮০ বর্গফুট করে মোট ৮০০ বর্গফুট জায়গা লাগবে। সেই সঙ্গে ওটি রুম, পোস্ট ওপারেটিভ রুম, ওয়াস রুম, ইনস্ট্রুমেন্ট রুম, লেবার রুম, ডক্টরস ডিউটি রুম, নার্সেস ডিউটি রুম, অপেক্ষমাণ কক্ষ, অভ্যর্থনাকক্ষ, অফিস কক্ষ, চেইনঞ্জিং রুম, স্টেরিলাইজার রুম, ভান্ডার রুমসহ সামঞ্জস্যপূর্ণ অন্তত ১৩টি রুম থাকতে হবে।
এছাড়া পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা প্রয়োজনীয়সংখ্যক টয়লেট, প্রশস্ত সিঁড়ি, জেনারেটরসহ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে (বিল্ডিং তিনতলার অধিক হলে) লিফটের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ওটি রুমে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, ওটি টেবিল, পর্যাপ্ত ওটি লাইট, সাকার মেশিন, অ্যানেসথেসিয়া মেশিন, ডায়াথারমি মেশিন, জরুরি ওষুধসমূহের ট্রে, রানিং ওয়াটার, অক্সিজেন, আইপিএসের ব্যবস্থা থাকতে হবে। সাধারণ বর্জ্য, ধারালো বর্জ্য, জীবাণুযুক্ত বর্জ্য, তরল বর্জ্যসহ সব ধরনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও থাকা অত্যাবশ্যকীয়। জনবলকাঠামোতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, তিন জন ডিউটি ডাক্তার, ছয় জন ডিপ্লোমা নার্স, প্রয়োজনীয় অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী, ওয়ার্ডবয়, আয়া, ক্লিনার থাকতে হবে। কিন্তু এসব নিয়ম-নীতির কোনো তোয়াক্কা না করে ছোট ছোট তিন-চার রুমের বাসাবাড়িতে ক্লিনিক গড়ে তুলে চিকিৎসার নামে প্রতারণা চলছে হরদম।
রাজশাহীর বেশির ভাগ ডায়াগনস্টিক সেন্টারেই চাহিদার ন্যূনতমও বিদ্যমান নেই। নেই প্যাথলজিক্যাল স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ। তার পরও এসব প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য বিভাগের অনুমোদন পায়। স্বাস্থ্য বিভাগের মদতে গড়ে ওঠা মানহীন এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সরকারি হাসপাতাল, রেল স্টেশন, বাস স্ট্যান্ডসহ গ্রামাঞ্চল থেকে দালালের মাধ্যমে রোগী ধরে এনে চিকিৎসাসেবার নামে প্রতারণা করছে প্রতিনিয়ত।
রাজশাহীতে স্থাপিত বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিক সমিতির সভাপতি ডা. এম এ মান্নান বলেন, তাদের সমিতিভুক্ত ১২০টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ৪০টি ক্লিনিক ও ৮০টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সমিতির বাইরেও কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে বলে তিনি স্বীকার করেছেন।
রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. গোপেন্দ্র নাথ আচার্য্য বলেন, এগুলো সরেজমিনে তদন্ত ও পর্যবেক্ষণের সরাসরি দায়িত্ব জেলা সার্জনের ওপর ন্যস্ত। সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে প্রতিটি জেলায় একটি করে কমিটি রয়েছে এসব দেখার জন্য। বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকেরও কিছু দায় রয়েছে, যা সত্যিকার অর্থে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবতার নিরিখে আপস করতে বাধ্য হচ্ছি।
তবে মতামতের জন্য অনেক চেষ্টা করেও জেলা সিভিল সার্জন ডা. এনামুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
ইত্তেফাক/জেডএইচ
সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক