সদ্যপ্রয়াত কিংবদন্তী শিল্পী এন্ড্রু কিশোরের সঙ্গে নানা সম্পর্কের গল্প, হাসি-ঠাট্টা আনন্দের মূল্যবান স্মৃতি রয়েছে অনেকের। এর ভেতরে কেউ বন্ধু, কেউ সহকর্মী আর বিশ্বজোড়া অগণিত ভক্তকূল। কিন্তু জীবনের শেষ সময়ে, সবচেয়ে কঠিনতম দিনগুলোতে যার কাছে শিল্পী এন্ড্রু কিশোর সুখ-দুঃখের কথা শেয়ার করেছেন, চিকিত্সারত অবস্থায় সবকিছু অকপটে বলেছেন, তিনি সিঙ্গাপুর প্রবাসী বাঙালি ব্যবসায়ী মোহা: সাহিদুজ্জামান টরিক। শিল্পীর শেষ জীবনে একান্তে কাটানো স্মৃতি নিয়ে লিখেছেন তিনি। ইত্তেফাক পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো সেই অমূল্য স্মৃতিগদ্য। আজ প্রকাশ করা হলো শেষ কিস্তি— মোহা: সাহিদুজ্জামান টরিক
সিঙ্গাপুরের চিকিত্সকরা যেদিন বৌদিকে বলে দিলেন দুঃসংবাদটি। খবরটি শুনে আমরা মনটা দমে গেল! এতদিন দাদার খুব কাছে ছিলাম। সকাল বিকেল বা বিভিন্ন সময়ে সময় কাটিয়েছি। অস্বস্তিও লাগলো। দাদা আমাকে হোটেল রুমে ডাকলেন। গিয়ে দেখি বৌদি কাঁদছেন। আমি নানারকম কথা বলে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছি। দেখি উল্টো আমাকেই বোঝাচ্ছেন দাদা।
—‘সাহিদ, টাইম টু ফ্লাই। আমার সময় শেষ। তুমি আমার জন্য অনেককিছু করেছ। এখানে আরো কিছু চেক আপের জন্য থাকতে বলা হচ্ছে। কিন্তু আমি আর এক মুহূর্তও থাকতে চাই না। তুমি আমার যাওয়ার ব্যবস্থা করো।’
সারাবিশ্বে করোনা সংকটে। সে সময় রেগুলার ফ্লাইট বন্ধ। আমি বললাম, দাদা কোনো টেনশন করবেন না। আমি সব ব্যবস্থা করছি।
আমি দাদাকে আমার পরিচিত কয়েকটা রেফারেন্স দিয়ে বুঝাতে লাগলাম। বললাম, দাদা আমার পরিচিত অনেককেই আমি হাসপাতালে ভর্তি থেকে শুরু করে নানান সেবা দিয়েছি। তাদের অনেককেই সিঙ্গাপুরের ডাক্তাররা ফিরিয়ে দিয়েছে। বলেছে, আর এক ২ মাস আয়ু আছে। কিন্তু দেশে ফিরে দেখা গেছে অনেকেই ৪/৫ বছর ধরে এখনো বেঁচে আছেন। হায়াত-মউত সবই উপরওয়ালার হাতে। এসব নিয়ে চিন্তা করে মানুষের কোনো লাভ নেই।
দাদা বললেন, ‘তোমাকে কে বললো আমি চিন্তা করছি। আমার দেশে বেশকিছু কাজ বাকি। আর থাকতে ইচ্ছে করছে না। এখানে থেকে আর লাভ নেই। তুমি আমার যাওয়ার ব্যবস্থা করো।’ অথচ! মাত্র দু’দিন আগেই সারাদেশে কোথায় কোথায় কনসার্ট করে হাসপাতাল গড়ার জন্য ফান্ড তুলবেন সেই পরিকল্পনায় ব্যস্ত ছিল মানুষটি। সেই মানুষটিই হঠাত্ স্তম্ভিত হয়ে গেল। গম্ভীর হয়ে গেল। অনিবার্য মৃত্যুর দিন তারিখ বোধহয় মানুষের জানতে নেই। জানলে সব আনন্দ ফুরিয়ে যায়। মানুষ তখন কোনোকিছুতেই আনন্দ পায় না। কী এক মায়ার জীবন! দাদার রুম থেকে বের হয়ে নিচে দাঁড়িয়ে আমিও বারবার চোখ মুছছিলাম। দাদার ঘরে অনেকক্ষণ নিজেকে সামলে রেখে শক্ত ছিলাম।
পরে অফিসে গিয়েই এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করলাম। হাইকমিশনের সঙ্গে কথা বললাম। দাদা আবার ফোন করে বললেন, ‘সাহিদ শোনো তোমার ভাবির কাছে যা ডলার আছে তুমি নিয়ে যাও। এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া তো অনেক। বাকিটা আমি দেশে ফিরেই পাঠানোর ব্যবস্থা করবো। তুমি এখনই আসো হোটেলে। ডলারগুলো নিয়ে যাও।’ আমি বললাম, আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। সন্ধ্যায় দেখা করে নিয়ে নেব। এসব নিয়ে ভাববেন না। আজ দিনে কোনো ব্যবস্থা হয়নি। রাতে ফ্লাইট ছাড়বে। সন্ধ্যায় সময় মতো গাড়ি আপনাদের লাগেজ নিয়ে যাবে। এন্ড্রু দা বারবার বলতে লাগলেন টাকাগুলো নিয়ে আসতে। আমি খুবই অবাক ও বিব্রত হলাম। আজ একটা কথা বলতেই হয়, এতটা আত্মসম্মানবোধ মানুষকে আমি খুব কম পেয়েছি। কোনো রেস্টুরেন্টেও তিনি কাউকে বিল দিতে দিতেন না!
আমি অফিসে যেতে না যেতেই আবারো দাদা ফোন করলেন। ঠিক একই অস্থিরতা।—সাহিদ তুমি টিকেট করেছো। আমি হাইকমিশনে কথা বলছি। তুমি আমার যাওয়ার ব্যবস্থা করো। আর এক মুহূর্ত আমি সিঙ্গাপুরে থাকতে চাই না।
সন্ধ্যায় সময়মতো দাদাকে নিয়ে আমরা এয়ারপোর্টে গেলাম। দাদা বললেন, ‘সাহিদ শেষবারের মতো তোমাকে একটু দেখে নিই। আর তো দেখা হবে না।’ আমি কোনো উত্তর দিতে পারিনি। দাদা চলে গেলেন। চলেই গেলেন ! ঢাকায় গিয়েই আমাকে জানিয়েছেন। খোঁজ নিয়েছেন। এরপর আমার প্রতি ওয়াক্তের নামাজের প্রার্থনায় দাদার জন্য দোয়া করেছি। যেদিন মারা গেলেন সিঙ্গাপুরে তখন মাগরিবের ওয়াক্ত। কী মনে করে ফোন দিলাম বৌদির নম্বরে। অন্য একজন ধরে বললেন, ‘দাদা তো নেই। এই মাত্র মারা গেলেন।’ ঠিক ঐ সময়টাতেই দাদার মৃত্যু। আমি বললাম, আমি নামাজে দাঁড়াচ্ছি। বৌদিকে বইলো আমি শুনেছি, প্রার্থনা করছি।’ জীবন এক মায়ার খেলাঘর। নয়তো অনেক শিল্পীদের সঙ্গেই পরিচয়, ওঠা-বসা। কিন্তু একজন এন্ড্রু কিশোরের শেষজীবনে তিনি এভাবে আমাকে তার মায়ায় জড়াবেন ভাবতে পারিনি। ভালো থাকবেন দাদা। আপনাকে ভীষণ মিস করবো। মিস করবে সারাবিশ্বের অগণিত বাঙালি শ্রোতা।
লেখক: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সাহিদ গ্রুপ-সাবেক সভাপতি সিঙ্গাপুর বাংলাদেশ সোসাইটি ও বিজনেস চেম্বার অব সিঙ্গাপুর।
সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক